ভূতের বিজ্ঞান: কেন কিছু মানুষ ‘ভূতের উপস্থিতি’ অনুভব করেন?

প্রাচীনকাল থেকে মানুষ ভূত-প্রেত বা অতিপ্রাকৃত শক্তির গল্প শুনে এসেছে। অন্ধকার ঘরে আচমকা শব্দ, কাঁধে কারও হাতের স্পর্শ, বা হঠাৎ শীতল হাওয়া—এই সব অভিজ্ঞতা অনেকেই "ভূতের উপস্থিতি" বলে ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু বিজ্ঞানের চোখে দেখলে, এই ‘ভূতের অনুভব’ ব্যাখ্যার জন্য অতিপ্রাকৃত কিছু নয়, বরং আমাদের মস্তিষ্ক, মন এবং পরিবেশগত কিছু প্রভাব দায়ী।

চলুন দেখে নেওয়া যাক ভূতের অভিজ্ঞতার পেছনে থাকা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলি—


১. ইনফ্রাসাউন্ড বা অদৃশ্য শব্দ তরঙ্গ

আমাদের কানের শ্রবণসীমা ২০ হার্জ থেকে ২০,০০০ হার্জ পর্যন্ত। কিন্তু কিছু শব্দ তরঙ্গ থাকে ২০ হার্জের নিচে—যা আমাদের শ্রবণশক্তির বাইরে। একে বলে ইনফ্রাসাউন্ড।গবেষণায় দেখা গেছে, এই ইনফ্রাসাউন্ড আমাদের শরীরে অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করতে পারে—বুক ধড়ফড় করা,ঠান্ডা লাগা,উদ্বেগ।এমনকি ‘কেউ পাশে আছে’ এমন অনুভূতিও।পুরনো বাড়ি, ভূগর্ভস্থ স্থান বা বড় যন্ত্রপাতির কম্পনের মাধ্যমে এই ধরণের শব্দ সৃষ্টি হতে পারে।

২. ব্রেন ম্যাপিং এবং স্নায়ুবিক বিভ্রম বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট অংশ উদ্দীপিত হলে মানুষ "অদৃশ্য উপস্থিতি" অনুভব করতে পারে।সুইজারল্যান্ডের নিউরোসায়েন্টিস্ট ড. ওলাফ ব্ল্যাঙ্ক এক গবেষণায় দেখান—

যখন তিনি টেম্পোরাল প্যারাইটাল জাংশন নামক মস্তিষ্কের অংশে ইলেকট্রিক স্টিমুলেশন দেন, তখন অনেকেই মনে করেন কেউ তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। এই অংশটি শরীরের নিজস্ব অবস্থান ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক বোঝে। এর গোলমাল মানেই বিভ্রান্তি।

৩. স্লিপ প্যারালাইসিস বা ঘুম পঙ্গু দশা

অনেকেই ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠে বোঝেন যে তারা নড়তে পারছেন না, অথচ ঘরে কেউ যেন হাঁটছে বা দাঁড়িয়ে আছে। এটাই স্লিপ প্যারালাইসিস। REM ঘুমের সময় মস্তিষ্ক সচল থাকলেও শরীর পঙ্গু হয়ে যায়। এই সময় হ্যালুসিনেশন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অতীতের অনেক ভূতের গল্প আসলে এই ঘুম সংক্রান্ত বিভ্রম থেকেই সৃষ্টি।

৪. তাপমাত্রা পরিবর্তন ও ড্রাফট ইফেক্ট

হঠাৎ ঘরে ঠান্ডা হাওয়া বইলে অনেকে ভূতের অস্তিত্ব ধরে নেন। কিন্তু বিজ্ঞান বলছে—ঘরের বাতাস চলাচলের প্রাকৃতিক প্যাটার্ন বা ড্রাফট এর ফলে এ রকম ঠান্ডা অনুভব হয়। পুরনো বাড়িতে দেয়ালের ফাঁক বা জানালার গ্যাপে সহজেই বাতাস ঢুকে পড়ে।

৫. পার্সিডোলিয়া: অবয়ব খোঁজার স্বাভাবিক প্রবণতা

আমাদের মস্তিষ্ক পরিচিত মুখ বা অবয়ব খুঁজে নিতে অভ্যস্ত এমনকি যেখানে আসলে কিছু নেই। একে বলে Pareidolia। মেঘে মুখ দেখা, দেয়ালে ছায়ায় ভূতের মুখ দেখা—সবই এই মানসিক প্রক্রিয়ার ফসল। কম আলো, ধোঁয়া বা ছায়ায় এই বিভ্রম আরও বেড়ে যায়।


৬. কার্বন মনোক্সাইড বিষক্রিয়া

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের বিষক্রিয়ায় মাথা ঘোরা, হ্যালুসিনেশন, ও ‘অদৃশ্য উপস্থিতি’র অনুভূতি তৈরি হতে পারে। গ্যাস লিকেজ বা ভেন্টিলেশনের সমস্যাযুক্ত বাড়িতে এধরনের ঘটনা বেশি ঘটে।

৭. মানসিক অবস্থা ও বিশ্বাস

মানুষের ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ব্যক্তিগত বিশ্বাস তার অনুভবকে প্রভাবিত করে। যারা ভূতে বিশ্বাস করেন, তারা সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে চান। একাকীত্ব, মানসিক চাপ বা শোককালীন অবস্থায় ‘ভূতের অনুভব’ বেড়ে যেতে পারে।

যদিও ভূত নিয়ে রহস্য ও কৌতূহল চিরকালীন, তবে বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, বেশিরভাগ 'ভূতের অভিজ্ঞতা' আসলে মানব মস্তিষ্ক, শরীর এবং পরিবেশের পারস্পরিক ক্রিয়ার ফল।

সুতরাং, পরের বার আপনি যদি ঘরে হঠাৎ ছায়ামূর্তি দেখেন বা কান পাতলে অজানা শব্দ শোনেন—আগে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করুন।

👻 ভূত নয়, মস্তিষ্কের খেলা!


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ