পারসি নববর্ষ: দুই ক্যালেন্ডারের এক অনন্য গল্প


প্রতিবছর ভারতের পারসি সম্প্রদায় নববর্ষ উদযাপন করে এক অনন্য ঐতিহ্য ও ধর্মীয় উৎসব হিসেবে। তবে এই নববর্ষকে ঘিরে রয়েছে একটি অদ্ভুত কিন্তু চমকপ্রদ বিষয়—দুইটি ভিন্ন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী উদযাপন। ইতিহাস, ধর্ম, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির এক মিশেলে তৈরি হয়েছে পারসি নববর্ষের এই বিশেষ পরম্পরা।


প্রাচীন পারস্যের উৎসব 

‘নবরোজ’ শব্দটি এসেছে ফারসি "নও" (নতুন) ও "রোজ" (দিন) শব্দ থেকে—অর্থাৎ নতুন দিন।

এই নববর্ষের উৎস প্রাচীন পারস্য সভ্যতার সময়, প্রায় ৩,০০০ বছর পূর্বে। ফারসি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বসন্তের প্রথম দিনকে (প্রায় ২১ মার্চ) বছর শুরুর দিন হিসেবে মানা হতো। এই দিনটিকে এখনও ইরান, মধ্য এশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য জোরােস্ট্রিয়ান (Zoroastrian) সম্প্রদায় উৎসব হিসেবে পালন করে।

তবে ভারতের পারসিরা এই নববর্ষটি অন্য এক তারিখে, অর্থাৎ আগস্ট মাসে উদযাপন করে। কেন এই ভিন্নতা? এর উত্তর লুকিয়ে আছে দুইটি আলাদা ক্যালেন্ডারে।


দুই ক্যালেন্ডার: শাহেনশাহী ও ফাসলি

১. ফাসলি (Fasli) ক্যালেন্ডার – মার্চে উদযাপিত হয়,

অনুসরণ করে সূর্য-ভিত্তিক জ্যোতির্বিজ্ঞান।২১ মার্চ (বসন্ত বিষুব) দিনটিতে পালন করা হয়।এই দিনটি পরিচিত “জামশেদি নবরোজ” নামে।মধ্য এশিয়ার জোরােস্ট্রিয়ান ও কিছু ভারতীয় পারসিরা পালন করে।

২. শাহেনশাহী (Shahenshahi) ক্যালেন্ডার – আগস্টে উদযাপিত হয়।এটি একটি প্রাচীন পারসি ক্যালেন্ডার, যা লিপ ইয়ার (Leap Year) অনুসরণ করে না।ফলে প্রতি বছর দিনটি কিছুটা করে পিছিয়ে যায়।ভারতের মুম্বাই, গুজরাট, পুনে ও হায়দরাবাদের পারসিরা এই তারিখ অনুযায়ী আগস্ট মাসে নববর্ষ পালন করেন।

একই ধর্মীয় সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও এই ভিন্ন ক্যালেন্ডারের কারণে পারসি নববর্ষ দুইটি আলাদা তারিখে পালন করা হয়। কেউ পালন করেন বসন্তে, কেউ করেন বর্ষায়।


কেন এই বিভেদ?

৮ম–১০ম শতাব্দীর দিকে, ইসলামি বিজয়ের ফলে পারস্যে জোরােস্ট্রিয়ান ধর্ম অনুসরণকারীদের ওপর দমন-পীড়ন শুরু হয়।এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে অনেক জোরােস্ট্রিয়ান ভারতে (গুজরাট অঞ্চলে) আশ্রয় নেন এবং পরিচিত হন পারসি নামে।তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে আসেন শাহেনশাহী ক্যালেন্ডার, যা আজও ভারতের পারসিরা অনুসরণ করেন।তবে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে যারা ফারসি সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ থেকেছেন, তারা ফাসলি ক্যালেন্ডার অনুসরণ করেন। এই কারণেই দুই ভিন্ন নববর্ষ প্রচলিত হয়।


কিভাবে উদযাপন করা হয় পারসি নববর্ষ?

যেই দিনেই নববর্ষ হোক না কেন, উদযাপন পদ্ধতিতে খুব বেশি পার্থক্য নেই। দিনটি ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

✒ ধর্মীয় আচার:পারসি জনগণ আগুনি বা ‘আতশ বাহরাম’ নামে পরিচিত আগুনের উপাসনালয়ে প্রার্থনা করেন।


"জশান" নামে পরিচিত একধরনের উপাসনায় অংশ নেন, যেখানে ফুল, ফল, জল ও ধূপ উৎসর্গ করা হয়।আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়। 

✒সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক:

ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে রঙোলি, ফুল ও তোরণে সাজানো হয়।পরিধান করা হয় নতুন জামাকাপড়। রান্না হয় বিশেষ পারসি খাবার: পাত্রা-নি-মাছি (পাতায় মোড়ানো মাছ),ধান-দার (ডাল-ভাত),সালি বোটি (মাংসের ঝোল), রাভো ও লাগান-নু-কাস্টার্ড (মিষ্টান্ন)

✒মানবিকতা ও দান:

পারসি সম্প্রদায় এই দিনটিতে দান, দয়া ও সেবার মাধ্যমে নতুন বছর শুরু করতে পছন্দ করেন। এটি তাঁদের ধর্মের তিনটি মূলনীতির প্রতিফলন:

“সৎ চিন্তা, সৎ কথা, সৎ কাজ” (Good Thoughts, Good Words, Good Deeds)।


নবরোজ আজকের পৃথিবীতে

আজ, Navroz কেবল পারসিদের জন্যই নয়, বরং UNESCO-র স্বীকৃত একটি "Intangible Cultural Heritage of Humanity"। এটি উদযাপিত হয়— ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, তুরস্ক ও মধ্য এশিয়া,ভারতের পারসি সমাজে,বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা জোরােস্ট্রিয়ান ও ফারসি উৎসবপ্রেমীদের মাঝে।


উপসংহার

পারসি নববর্ষ কেবল একটি দিন নয়—এটি একটি ইতিহাস, বিশ্বাস, সংস্কৃতি ও অভিযোজনের প্রতিচ্ছবি। দুই ক্যালেন্ডারের এই গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে সময় ও স্থানের প্রেক্ষাপটে ঐতিহ্য রূপান্তরিত হয়, কিন্তু আত্মিকতাকে কখনো বদলায় না।

নবরোজ, যেটাই হোক—মার্চের দিন হোক বা আগস্টের, তার আত্মা এক: শুভ সূচনা, মনুষ্যত্ব, ও জীবনের উদযাপন।













একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ