বিশ্বজুড়ে নানা প্রজাতির পাখির সংখ্যা হ্রাস পাওয়া নতুন কিছু নয়। তবে ইতিহাসে এমন একটি নজির রয়েছে যেখানে একটি জাতিকে পরিকল্পিতভাবে প্রায় বিলুপ্ত করে ফেলা হয়েছিল – আর সেই ঘটনাটি ঘটেছিল চীনে, একটি ছোট পাখি, চড়ুই (sparrow)–কে কেন্দ্র করে। এই ঘটনা চীনের সমাজতান্ত্রিক ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত অধ্যায়, যা “Four Pests Campaign” নামে পরিচিত।
পটভূমি: 'ফোর পেস্টস ক্যাম্পেইন' কী?
১৯৫৮ সালে চীনের নেতা মাও জে দং ‘The Great Leap Forward’ নামক একটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক অভিযানের সূচনা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল চীনকে দ্রুত শিল্প ও কৃষিক্ষেত্রে উন্নত দেশে পরিণত করা। এরই অংশ হিসেবে তিনি চারটি "অপদ্রব্য" ধ্বংস করার আহ্বান জানান – মশা, ইঁদুর, মাছি এবং চড়ুই পাখি। চড়ুইকে ‘শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করার কারণ ছিল এর খাদ্যাভ্যাস। মনে করা হতো, এই পাখিগুলি ফসলের দানা খেয়ে চাষের ক্ষতি করছে। ধারণা করা হয়েছিল, একটি চড়ুই বছরে ৪ কেজি পর্যন্ত শস্য খেয়ে ফেলে। সেই যুক্তিতেই চড়ুই নিধনের অভিযান শুরু হয়।
নিধনের পদ্ধতি: কীভাবে চড়ুই বিলুপ্ত করা হয়?
চড়ুই ধ্বংসে চীনের জনগণকে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করা হয়। শিশু থেকে বৃদ্ধ, শহর থেকে গ্রাম—সবার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল একটি কাজ: চড়ুই মারা। ব্যবহৃত কৌশলগুলো:
⧪পাখিদের বিশ্রাম করতে না দেওয়া: মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেঁচামেচি করত, ঢাক-ঢোল বাজাত, পাত্র বা বাঁশির শব্দে চারপাশ গর্জে উঠত, যাতে পাখিরা কোথাও বসতে না পারে। ক্লান্ত হয়ে তারা আকাশেই মারা যেত।
⧪ঘরবাড়ি ও গাছপালা ধ্বংস: পাখির বাসা ভেঙে ফেলা হতো, ডিম ও বাচ্চাগুলো ধ্বংস করা হতো।
⧪পুরস্কার ঘোষণা: যে যত বেশি চড়ুই মেরে আনতে পারত, তাকে পুরস্কৃত করা হতো। স্কুল, কল-কারখানায় গোষ্ঠীগত প্রতিযোগিতা চলত। Read More⏩
বিপর্যয়ের শুরু: প্রকৃতির প্রতিশোধ
প্রথমদিকে মনে করা হয়েছিল, এই উদ্যোগ সফল হচ্ছে। চড়ুই পাখির সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পায়। তবে পরিণতি ছিল ভয়ঙ্কর।
কী ঘটল পরে?
চড়ুই শুধুমাত্র শস্য নয়, পোকামাকড়ও খেত – বিশেষ করে ফসল ধ্বংসকারী পোকা যেমন পঙ্গপাল ও চুঁই পোকা। চড়ুই বিলুপ্ত হওয়ার পর এই ক্ষতিকর পোকামাকড়ের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যায়। ফলে ফসলের উপর আরও ভয়াবহ আক্রমণ হয় এবং ব্যাপক খাদ্যসংকট দেখা দেয়। Read More⏩
দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যু
এই ভুল সিদ্ধান্তের ফলে চীন ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হয়।
১৯৫৯-১৯৬১ সালের মধ্যে এই দুর্ভিক্ষে প্রায় ৩০ মিলিয়ন (৩ কোটিরও বেশি) মানুষ প্রাণ হারায় বলে ধারণা করা হয়। চড়ুই নিধন ছিল সেই দুর্ভিক্ষের অন্যতম প্রধান কারণ।
পরিণামে কী হলো?
চড়ুই নিধনের ভুল বুঝতে পেরে মাও জে দং ১৯৬০ সালে চড়ুইকে "শত্রু" তালিকা থেকে বাদ দেন এবং তার জায়গায় “বিছানা পোকা” (bedbug)-কে রাখা হয়। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কিছু চড়ুই আমদানি করে পুনরায় পরিবেশে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়।
চীনে চড়ুই নিধনের ঘটনা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়—প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করা, বিশেষ করে পরিবেশের একেকটি উপাদানকে না বুঝে নির্মূল করা, মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
চড়ুই নিধনের এই অধ্যায় চীনের ইতিহাসে একটি ভুল পরিকল্পনার প্রতীক হয়ে আছে, যেখানে বিজ্ঞানের অভাবে নেওয়া সিদ্ধান্ত এবং পরিবেশগত অজ্ঞতা একটি গোটা জাতিকে দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেয়। পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র এবং প্রাণিকুলের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিজ্ঞানভিত্তিক সিদ্ধান্তই পারে ভবিষ্যতের জন্য টেকসই সমাধান গড়ে তুলতে।
#Four Pests Campaign #The Great Leap Forward #মাও জে দং
0 মন্তব্যসমূহ