ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনীতির প্রেক্ষাপটে ‘হিন্দুত্ব’ একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুমাত্রিক ধারণা। একদিকে এটি হিন্দু জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক রূপ, অন্যদিকে সমসাময়িক ভারতীয় রাজনীতির একটি অন্যতম আলোচিত আদর্শ। তবে হিন্দুত্ব এবং হিন্দু ধর্ম – এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ধর্মীয় বিশ্বাস, জাতীয় চেতনা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং সামাজিক আন্দোলনের সংমিশ্রণে গঠিত এই ধারণার রয়েছে বিস্তৃত প্রভাব ও বিতর্ক।
হিন্দুত্ব: একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ধারণার বিশ্লেষণ
হিন্দুত্বের ধারণা: সংজ্ঞা ও ঐতিহাসিক পটভূমি
‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি প্রথম জনপ্রিয়তা পায় বিনায়ক দামোদর সাভারকার-এর ১৯২৩ সালের রচনায় "Hindutva: Who is a Hindu?"। এখানে হিন্দুত্বকে কেবল ধর্মীয় পরিচয় নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক-জাতীয় চেতনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সাভারকারের মতে, যিনি "ভারতভূমিকে পিতৃভূমি ও পুণ্যভূমি" হিসেবে মানেন, তিনিই প্রকৃত হিন্দু।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে হিন্দুত্ব একটি জাতি-রাষ্ট্রভিত্তিক চেতনা, যা ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যকে প্রাধান্য দেয়।
হিন্দুত্ব ও রাজনীতি: সমসাময়িক বাস্তবতা
হিন্দুত্বের রাজনৈতিক রূপায়ণ শুরু হয় ঊনবিংশ শতকের শেষে এবং বিংশ শতকের গোড়ায়। এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখে একাধিক সংগঠন ও রাজনৈতিক দল:
■ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS):
১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন হিন্দু সমাজকে সাংগঠনিক শক্তিতে রূপান্তর করার লক্ষ্যে কাজ করে। হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শে RSS একটি কেন্দ্রবিন্দু।
■ ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP):
এই দল হিন্দুত্বের রাজনৈতিক ব্যাখ্যা বাস্তবায়নে সক্রিয়। রাম মন্দির আন্দোলন, সিএএ, এনআরসি ও ধর্মান্তরণ বিরোধী নীতিতে হিন্দুত্বের প্রভাব সুস্পষ্ট।
■ বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (VHP) ও বজরং দল:
হিন্দু ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি রক্ষায় সক্রিয় এই সংগঠনগুলোর কার্যক্রম হিন্দুত্বের সামাজিক প্রচারে ভূমিকা রাখে।
সাংস্কৃতিক দিক ও আদর্শিক স্তম্ভ
📌 ভাষা ও সাহিত্য:
হিন্দি, সংস্কৃত এবং প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের পুনর্জাগরণ হিন্দুত্বের সাংস্কৃতিক স্বত্বার অন্তর্ভুক্ত।
📌 যোগ, আয়ুর্বেদ ও জীবনদর্শন:
ভারতীয় প্রাচীন জীবনপদ্ধতির পুনর্ব্যবহার ও বিশ্বমঞ্চে পরিচিত করানো হিন্দুত্ববাদীদের অন্যতম লক্ষ্য।
📌 ‘ঘর ওয়াপসি’ আন্দোলন:
ধর্মান্তরিত হিন্দুদের পুনরায় হিন্দু ধর্মে ফেরানোর সামাজিক কর্মসূচিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী ঐক্যের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
📌 গো-রক্ষা ও পরিবেশবাদ:
গরুকে পবিত্র প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করে তার রক্ষায় সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্যোগ হিন্দুত্ববাদীদের অন্যতম কর্মসূচি।
⚖️ সমালোচনা ও বিতর্ক
হিন্দুত্ব নিয়ে নানা মহলে বিতর্ক বিদ্যমান। মূল অভিযোগগুলো হল:
❌ ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা:
অনেকে মনে করেন, হিন্দুত্বের আদর্শ ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের পরিপন্থী এবং এটি সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যের জন্ম দেয়।
❌ সাম্প্রদায়িক বিভাজনের অভিযোগ:
ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে রাজনীতি করার কারণে হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন অনেক সময় সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
❌ ইতিহাসের পুনর্লিখন:
হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা অনেক সময় ইতিহাসকে নতুন ব্যাখ্যায় উপস্থাপন করেন, যা একধরনের মতাদর্শিক ইতিহাসচর্চার সৃষ্টি করে।
হিন্দুত্ব একটি গভীর ও বহুস্তরবিশিষ্ট ধারণা। এটি ভারতের ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলেও, একে শুধুমাত্র ধর্মীয় পরিসরে সীমাবদ্ধ করা যায় না। আধুনিক ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো, বহুসংস্কৃতির সহাবস্থান এবং সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের সঙ্গে হিন্দুত্বের অবস্থান নিয়েই রয়েছে বিস্তর আলোচনা ও বিতর্ক।
অতএব, হিন্দুত্বকে বুঝতে হলে তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, সামাজিক প্রভাব এবং সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি সমন্বিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
#pragyabangla #প্রজ্ঞাবাংলা
1 মন্তব্যসমূহ
Nice article
উত্তরমুছুন