পাকিস্তানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত বেলুচিস্তান, ভূখণ্ডের দিক থেকে দেশটির বৃহত্তম প্রদেশ হলেও, ইতিহাসজুড়ে এটি সবচেয়ে অবহেলিত ও দমন-পীড়নের শিকার অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলটির ইতিহাস এক গভীর ক্ষোভ, উপেক্ষা ও সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। বেলুচিস্তানের সমস্যা শুধু অর্থনৈতিক বঞ্চনা বা রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বহীনতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি মূলত এক জাতির আত্মপরিচয় ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার লড়াই। এ লড়াইয়ের সূচনালগ্নেই জড়িয়ে আছে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বারা সংঘটিত এক ঐতিহাসিক বিশ্বাসঘাতকতা।
২০০৪ সালের এই ছবিতে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের মারি বেলুচ গোষ্ঠীর যোদ্ধারা। বেলুচ বিদ্রোহীরা ২০২৫ সালের ১১ মার্চ একটি ট্রেন ছিনতাই করে এবং শত শত যাত্রীকে জিম্মি করে রাখে। (ছবি: রয়টার্স)।
খান অব কালাত ও বেলুচিস্তানের প্রাক-পাকিস্তান ইতিহাস
বেলুচিস্তান মূলত বেশ কয়েকটি উপজাতীয় অঞ্চল নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিল খান অব কালাত। ১৮৭৬ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে কালাত একটি আধা-স্বাধীন রাজ্য হিসেবে গৃহীত হয়, এবং এটি ব্রিটিশ ভারতের অংশ হলেও তার অভ্যন্তরীণ শাসনে স্বাধীনতা বজায় রাখে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ত্যাগের পূর্বে খান অব কালাত, অন্যান্য রাজ্যগুলোর মতো, নিজস্ব সার্বভৌম অবস্থান নির্ধারণের অধিকার লাভ করে।
২১ মার্চ ১৯৪৮, খান আহমদ ইয়ার খান পাকিস্তানের সঙ্গে সংযুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানান এবং কালাতকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু এর মাত্র ছয় দিন পরেই, ২৭ মার্চ ১৯৪৮, পাকিস্তান সরকার সামরিক হুমকি ও চাপে পড়ে খানকে একটি তথাকথিত 'চুক্তিতে' স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে, যার মাধ্যমে কালাতকে পাকিস্তানে জুড়ে দেওয়া হয়। এটি ইতিহাসবিদদের মতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এক নির্মম কূটনৈতিক চাপ ও বিশ্বাসঘাতকতার উদাহরণ, কারণ জিন্নাহ নিজে এক সময় কালাত রাজ্যের আইনজীবী ছিলেন। Read More⏩
বেলুচ জনতার প্রতিক্রিয়া ও সশস্ত্র প্রতিরোধের সূচনা
খান অব কালাতের ছোট ভাই প্রিন্স আবদুল করীম প্রথম এই অনৈতিক সংযুক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম সশস্ত্র বিদ্রোহের সূচনা করেন, যেটি যদিও অল্প সময়ে দমন করা হয়, কিন্তু বেলুচ জনগণের মনে প্রতিরোধের বীজ বপন করে দেয়।
এরপর সময়ের ব্যবধানে আরও চারটি বড় আকারের বিদ্রোহ সংগঠিত হয় –
➩১৯৫৮-৫৯ (নওরোজ খানের নেতৃত্বে),
➩১৯৬২-৬৩,
➩১৯৭৩-৭৭ (বেলুচিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ),
➩২০০০ সালের পরবর্তী সময় থেকে চলমান বর্তমান বিদ্রোহ। Read More⏩
চলমান সশস্ত্র আন্দোলন ও আজকের বেলুচিস্তান
২০০৫ সালে আকবর বুগতির হত্যার পর, বেলুচিস্তানে বিদ্রোহ আবারও ব্যাপক আকার ধারণ করে। বর্তমানে সেখানে BLA (Baloch Liberation Army), BRA (Baloch Republican Army), UBL (United Baloch Army)-সহ একাধিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী সক্রিয়, যারা স্বাধীন বেলুচিস্তানের দাবিতে লড়াই করছে।
তাদের অভিযোগ:
➤বেলুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদ (গ্যাস, কয়লা, তামা, সোনা, বিশেষ করে রেকো ডিক খনি) লুট করা হচ্ছে।
➤সেনাবাহিনীর দ্বারা অপহরণ, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটছে।
➤বেলুচ জনগণকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়নে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
পাকিস্তান সরকার বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক মহলে এই দমন নীতির বিরুদ্ধে বহু মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
সাংস্কৃতিক ও পরিচয় সংকট
বেলুচ জনগণের মধ্যে পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের প্রতি বিরূপতা অনেকটাই নিজস্ব পরিচয়ের সংরক্ষণ ও আত্মসম্মানের লড়াই থেকে জন্ম নিয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে উর্দুর প্রাধান্য, পাঠ্যবইয়ে বেলুচ সংস্কৃতির অনুপস্থিতি, ও সেনা হস্তক্ষেপ বেলুচদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। অনেকেই দাবি করেন, পাকিস্তান রাষ্ট্র শুরু থেকেই বেলুচিস্তানের আত্মপরিচয় মুছে দিতে চেয়েছে।
0 মন্তব্যসমূহ