দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে সীমান্তবিরোধ আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে। ২৪ জুলাই থেকে শুরু হওয়া সংঘর্ষ চলে টানা পাঁচ দিন, যার ফলে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৪৩ জন, আহত হয়েছেন শতাধিক এবং প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়েছেন।
প্রাচীন মন্দির: সংঘর্ষের মূল কেন্দ্রবিন্দু
এই উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে দুটি ঐতিহাসিক মন্দির—প্রে ভিহেয়ার (Preah Vihear) এবং তা মুয়েন থম (Ta Muen Thom)। এই দুই মন্দিরই কম্বোডিয়ার খেমার সাম্রাজ্যের সময় নির্মিত হিন্দু স্থাপত্য, যা আজকের দিনে দুই দেশের জাতীয় পরিচয় ও গর্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
ঐতিহাসিক রায় ও বিতর্ক
*১৯৬২ সালে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (ICJ) ঘোষণা করে যে, প্রে ভিহেয়ার মন্দির কম্বোডিয়ার ভূখণ্ডে অবস্থিত।
*তবে, মন্দির সংলগ্ন প্রায় ৪.৬ বর্গকিলোমিটার জমির মালিকানা নিয়ে তখন কোনো সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি, ফলে এই অঞ্চল নিয়ে দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়ে যায়।
২০০৮ সালে UNESCO যখন প্রে ভিহেয়ারকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে, তখন থাইল্যান্ড এই ঘোষণার বিরোধিতা করে এবং পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হতে থাকে।
সাম্প্রতিক সংঘর্ষ: রক্তক্ষয় ও ধ্বংস
২০২৫ সালের জুলাই মাসে সংঘর্ষ নতুন মাত্রা পায়।
থাই সেনাবাহিনী অভিযোগ তোলে, কম্বোডিয়ার সৈন্যরা সীমান্ত লঙ্ঘন করে তাদের ঘাঁটিতে হামলা চালায়। পাল্টা অভিযোগে কম্বোডিয়া জানায়, থাই ফোর্সরা তাদের ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে এবং তা মুয়েন থম মন্দিরের আশপাশে আগ্রাসন চালিয়েছে।
সংঘর্ষে উভয় পক্ষ ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে:
*থাইল্যান্ড ব্যবহার করে F‑16 যুদ্ধবিমান ও কামান
*কম্বোডিয়া ছোড়ে BM‑21 গ্র্যাড রকেট ও মর্টার
প্রধানত থাইল্যান্ডের সিসাকেত প্রদেশ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। রকেট হামলায় একটি গ্যাস স্টেশন ও বেশ কয়েকটি ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়।
মানবিক বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক ক্ষতি
*প্রায় ৩ লক্ষ মানুষ সীমান্ত অঞ্চল থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সরে যেতে বাধ্য হন।
*থাই সরকার জানিয়েছে, এই সংঘর্ষে প্রায় ১০ বিলিয়ন বাহতের ক্ষতি হয়েছে এবং ২৫ বিলিয়ন বাহতের পুনর্বাসন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
মাদক চোরাচালান: সংঘর্ষের ছায়ায় অপরাধ
সীমান্তের অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার সুযোগ নিয়ে এই অঞ্চলে মাদক চোরাচালান বেড়ে গেছে।
বিশেষ করে মেথামফেটামিন ও হেরোইন পাচারে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিভিন্ন চক্র।
দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এ বিষয়ে একাধিক চোরাকারবারি আটক করলেও, সংঘর্ষ চলাকালে তাদের কার্যকারিতা সীমিত হয়ে পড়ে।
আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ও শান্তিচুক্তি
*মালয়েশিয়ার মধ্যস্থতায় ২৯ জুলাই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।
*যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, বর্তমানে এক আন্তর্জাতিক শান্তিদূত হিসেবে আলোচনায় সহায়তা করেন।
*থাইল্যান্ড এখনো কিছু কম্বোডিয়ান সেনাকে আটক রেখেছে; বিষয়টি নিয়ে আবারও উত্তেজনা দেখা দিতে পারে।
আগামী ৪–৭ আগস্ট মালয়েশিয়ায় দুই দেশের মধ্যে শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়েছে।
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যকার সীমান্ত বিরোধ শুধু একখণ্ড জমি নিয়ে নয়। এর মধ্যে রয়েছে ইতিহাস, ধর্ম, জাতীয়তা, ভূরাজনীতি এবং অপরাধ জগতের বহুস্তরীয় জটিলতা। মন্দির বিতর্ক শুধু ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন নয়, বরং বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতীকও।
এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান শুধুমাত্র সামরিক শক্তি দিয়ে সম্ভব নয়—এ জন্য প্রয়োজন আন্তঃদেশীয় সংলাপ, আস্থা গড়ে তোলা এবং সীমান্ত এলাকায় দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন ও নিরাপত্তা পরিকল্পনা।
0 মন্তব্যসমূহ