বিজ্ঞান কল্পকাহিনির পাতা ছাড়িয়ে বাস্তবতার পথে এগিয়ে চলেছে মানব সভ্যতা। চাঁদের পর এখন আমাদের দৃষ্টি মঙ্গল গ্রহের দিকে। প্রশ্ন উঠছে: যদি একদিন মানুষ সত্যিই মঙ্গল গ্রহে বসবাস শুরু করে, তবে তারা কীভাবে প্রথম নিঃশ্বাস নেবে? পৃথিবীতে তো বাতাস প্রস্তুত অবস্থায় পাওয়া যায়, কিন্তু লাল গ্রহের পরিবেশ আমাদের জন্য মোটেই বন্ধুসুলভ নয়। এই নিবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব, কীভাবে ভবিষ্যতের "মঙ্গলবাসী" মানুষ প্রথম শ্বাস নেবে, এবং বিজ্ঞান কীভাবে আমাদের সেখানে বসবাসযোগ্য পরিবেশ দিতে পারে।
মঙ্গলের পরিবেশ: একটা চ্যালেঞ্জ
মঙ্গল গ্রহের বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত পাতলা এবং পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ১০০ গুণ হালকা। এর ৯৫% হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড (CO₂), অক্সিজেনের পরিমাণ মাত্র ০.১৩%। এই পরিবেশে মানুষ এক মুহূর্তও বাঁচতে পারবে না। তাপমাত্রাও প্রচণ্ড কম (গড়ে -৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস), এবং প্রাকৃতিক বিকিরণ (radiation) আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
প্রথম নিঃশ্বাস: কৃত্রিম পরিবেশই ভরসা
মঙ্গলে মানুষের প্রথম নিঃশ্বাস যে সরাসরি বাইরের বাতাস থেকে হবে না, তা নিশ্চিত। বরং এটি ঘটবে কৃত্রিমভাবে তৈরি কোনো জীবন্ত ঘর বা "habitat"-এর ভেতর, যেখানে অক্সিজেন নিয়ন্ত্রিতভাবে সরবরাহ করা হবে। এই পরিবেশ তৈরি হবে সম্ভবত নিচের প্রযুক্তিগুলোর সাহায্যে:
১. MOXIE প্রযুক্তি: মঙ্গলের বাতাস থেকে অক্সিজেন তৈরি
NASA-র Perseverance রোভার ইতিমধ্যেই একটি পরীক্ষামূলক প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে, যার নাম MOXIE (Mars Oxygen In-Situ Resource Utilization Experiment)। এটি মঙ্গলের কার্বন ডাই-অক্সাইডকে বিভাজন করে অক্সিজেন তৈরি করতে পারে। ভবিষ্যতের জন্য বৃহৎ স্কেলে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে অক্সিজেন উৎপাদন সম্ভব হবে। এই অক্সিজেন সংরক্ষণ করে, মানুষ ভবিষ্যতে তা ব্যবহার করে নিঃশ্বাস নিতে পারবে।
২. জীবন্ত ডোম বা “বায়োডোম”
বিজ্ঞানীরা মঙ্গলে গম্বুজ আকৃতির “বায়োডোম” তৈরির কথা ভাবছেন, যেখানে ভিতরে উদ্ভিদ চাষ করা হবে। এই গাছগুলো কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন তৈরি করবে, অনেকটা পৃথিবীর মত। এতে করে একটি ছোট কিন্তু স্বনির্ভর বাসস্থান তৈরি হতে পারে। ভবিষ্যতের মঙ্গলবাসীরা এই ডোমের ভিতরে বসবাস করে নিরাপদে নিঃশ্বাস নিতে পারবে। Read More⏩
৩. হেলমেট ও অক্সিজেন ব্যাকপ্যাক
বাইরের পরিবেশে কাজ করার সময় তারা পরবে বিশেষ স্পেসস্যুট, যার সঙ্গে থাকবে অক্সিজেন ব্যাকপ্যাক। এই প্রযুক্তি অ্যাস্ট্রোনটদের পৃথিবীর বাইরে কাজ করতে দেয়। মঙ্গলে হাঁটার সময় এটাই হবে তাদের ভরসা।
৪. ভবিষ্যতের গ্রীনহাউস প্রযুক্তি
মঙ্গলে খাদ্য ও অক্সিজেনের জন্য হাই-টেক গ্রীনহাউস ব্যবহার করা যেতে পারে। এখানে সূর্যের আলো কাজে লাগিয়ে উদ্ভিদ জন্মাবে, এবং সেই গাছই অক্সিজেন সরবরাহ করবে। ফলে একটি প্রাকৃতিক চক্র (photosynthesis) তৈরি হবে যা ভবিষ্যতের বসবাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
Elon Musk-এর SpaceX ইতিমধ্যেই ২০৫০ সালের মধ্যে মানুষের মঙ্গলে বসবাসের কথা বলেছে।
NASA ও অন্যান্য মহাকাশ সংস্থা সক্রিয়ভাবে গবেষণা চালাচ্ছে কীভাবে সুরক্ষিতভাবে অক্সিজেন তৈরি ও সংরক্ষণ করা যায়।
একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠান মঙ্গলে বাসযোগ্য পরিবেশ তৈরির জন্য "Mars Habitat Challenge"-এ অংশ নিচ্ছে। Read More⏪
মঙ্গলে মানুষের প্রথম নিঃশ্বাস নিঃসন্দেহে হবে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। তবে সেই শ্বাস হবে প্রকৃতির উপহার নয়, বরং বিজ্ঞানের সাফল্যের প্রতীক। অক্সিজেন তৈরির জন্য MOXIE, উদ্ভিদের সহায়তা, কৃত্রিম ডোম, এবং আধুনিক প্রযুক্তিই মানুষকে সেখানে বাঁচিয়ে রাখবে। যদি সবকিছু পরিকল্পনা মত চলে, তবে হয়তো আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই আমরা শুনব সেই কাঙ্ক্ষিত খবর:
"একজন মানুষ মঙ্গলে নিরাপদে নিঃশ্বাস নিয়েছেন!"
বিশেষ তথ্য
মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে ১% এর কম অক্সিজেন রয়েছে।
MOXIE প্রতি ঘণ্টায় ১০ গ্রাম পর্যন্ত অক্সিজেন তৈরি করতে পারে (এই পরিমাণে একজন মানুষ ১০ মিনিট বাঁচতে পারে)।
বিজ্ঞানীরা কৃত্রিম বায়োম তৈরি করে মঙ্গলে 'পরিবেশ বান্ধব বসতি' গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
0 মন্তব্যসমূহ