১৯১২-১৯৫১: কার্যত স্বাধীন তিব্বতের ইতিহাস

চিং সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯১২ সাল থেকে ১৯৫১ পর্যন্ত তিব্বত কার্যত স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে ছিল। তৎকালীন তিব্বতীয় গ্যান্ডেন ফোদরঙ্গ শাসন চিং রাজবংশের অধীন থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়, যা ১৯৫০-এর দশকে গণচীনের আগ্রাসন পর্যন্ত কার্যকর ছিল। চীন প্রজাতন্ত্র চিং সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে তিব্বতকে স্বায়ত্তশাসিত প্রোটেকটোরেট হিসেবে দাবি করলেও, তিব্বত এই সময় চীনা প্রভাব অস্বীকার করে কার্যত স্বাধীনভাবে শাসিত হয়। এ সময় ব্রিটিশ ভারতও লাসা সন্ধির মাধ্যমে তিব্বতে প্রভাব বিস্তার করেছিল, যদিও তিব্বত কখনো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়নি।

তিব্বতের ইতিহাস: তিব্বত কি স্বাধীন দেশ? চীনের তিব্বত দখল


১৯৫১ সালের ২৪ অক্টোবর, তৎকালীন তিব্বত সরকার সতেরো দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে তিব্বতকে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের (পিআরসি) নিয়ন্ত্রণে আনলেও, পরবর্তীতে ১৪তম দালাই লামা এই চুক্তিকে চাপের মুখে স্বাক্ষরিত বলে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৫০ সালের অক্টোবরে চীনা সেনাবাহিনী পশ্চিম খামের চামডো এলাকায় আক্রমণ চালায়, যার প্রেক্ষিতে হাজার হাজার তিব্বতি হতাহত হন। চীন সরকার একে “তিব্বতের শান্তিপূর্ণ মুক্তি” বলে বর্ণনা করলেও, কেন্দ্রীয় তিব্বত প্রশাসন ও প্রবাসী তিব্বতীরা একে “চীনা আক্রমণ” বলেই বিবেচনা করে। তিব্বতের স্বাধীনতার প্রশ্ন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সামরিক আধুনিকীকরণের প্রয়াস এই ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। Read More⏩

তিব্বতের স্বাধীনতা ও ইতিহাস

তিব্বত প্রাচীনকাল থেকেই একটি স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ভাষার অধিকারী অঞ্চল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে পরিচালিত হয়েছে, বিশেষত ১৩৯১ সাল থেকে দলাই লামা প্রথার সূচনা হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বও ধর্মীয় নেতার হাতে চলে যায়।

তিব্বতের ইতিহাস: তিব্বত কি স্বাধীন দেশ? চীনের তিব্বত দখল
                স্বাধীন তিবতের জাতীয় পতাকা

চীনের আগ্রাসন: ১৯৫০ সালের দখল

চীনের কমিউনিস্ট সরকার ১৯৪৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই তিব্বতকে "ঐতিহাসিকভাবে চীনের অংশ" দাবি করে। ১৯৫০ সালে চীন "পিপলস লিবারেশন আর্মি" পাঠিয়ে তিব্বতের পূর্বাঞ্চল আক্রমণ করে। এই অভিযানের মাধ্যমে তিব্বতের ওপর সামরিক দখল প্রতিষ্ঠা পায়। ১৯৫১ সালে তিব্বতের প্রতিনিধিদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে “সপ্তদশ দফা চুক্তি” স্বাক্ষর করানো হয়, যেখানে তিব্বতের অভ্যন্তরীণ স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও চীন খুব দ্রুত তা লঙ্ঘন করে।

তিব্বতের ইতিহাস: তিব্বত কি স্বাধীন দেশ? চীনের তিব্বত দখল
                 চিত্রে দলাই লামা এবং চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান মাও জে দং 

দলাই লামার নির্বাসন

১৯৫৯ সালে তিব্বতের রাজধানী লাসায় বড় ধরনের গণ-বিদ্রোহ শুরু হয় চীনা নিপীড়নের বিরুদ্ধে। PLA বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করে, হাজার হাজার তিব্বতবাসী নিহত হয়। দলাই লামা প্রাণ বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। তারপর থেকেই তিনি ধর্মশালায় নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন এবং বিশ্বজুড়ে তিব্বতের স্বাধীনতার জন্য কূটনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। 

মানবাধিকার লঙ্ঘন

চীনা দখলের পর থেকে তিব্বতে ধারাবাহিকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

ধর্মীয় দমন: বৌদ্ধ মঠ ধ্বংস, ভিক্ষুদের গ্রেফতার, ধর্মীয় শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা।

সংস্কৃতির অবমূল্যায়ন: তিব্বতি ভাষা, পোশাক, শিক্ষা ও ঐতিহ্যকে চীনা কৃষ্টি দ্বারা প্রতিস্থাপন করার প্রচেষ্টা।

গুম ও নির্যাতন: চীনা সরকারের সমালোচক, ভিক্ষু ও স্বাধীনতাকামীদের গোপনে গুম, নির্যাতন ও দীর্ঘ কারাবাস।

জনসংখ্যা পরিবর্তন: হান চীনা জনগোষ্ঠীকে তিব্বতে পুনর্বাসনের মাধ্যমে স্থানীয় তিব্বতিদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করার নীতি।

তিব্বতের ইতিহাস: তিব্বত কি স্বাধীন দেশ? চীনের তিব্বত দখল

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

তিব্বতের পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে নানা সময় উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণে বড় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রভৃতি সংস্থা বহুবার চীনের বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। Read More⏩

দলাই লামা সংকট ও ভবিষ্যৎ

দলাই লামা আজীবন অহিংস আন্দোলনের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি ‘মধ্যপন্থা’ নীতির মাধ্যমে চীনের অধীনে তিব্বতের প্রকৃত স্বায়ত্তশাসন চান। কিন্তু চীন সরকার তাঁকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আখ্যা দেয়। দলাই লামার উত্তরসূরি নির্বাচনের বিষয়েও চীন হস্তক্ষেপ করার ইঙ্গিত দিয়েছে, যা আরও বড় সংকটের ইঙ্গিত দেয়।


তিব্বত আজও চীনের দখলে পরাধীন। একসময়ের স্বাধীন ও সমৃদ্ধ বৌদ্ধ রাজ্য আজ মানবাধিকার লঙ্ঘন, সাংস্কৃতিক দমন ও রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার। দলাই লামার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন বিশ্বে উদাহরণ হয়ে থাকলেও, এখনো তিব্বতের মুক্তির পথ কঠিন ও অনিশ্চিত। আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত এই সংকটে আরো দৃঢ় ও মানবিক ভূমিকা নেওয়া।