বিরল খনিজ (Rare Earth Minerals), চীনের আধিপত্য, ও ভূরাজনৈতিক সংঘর্ষ

বিরল খনিজ কি? Rare Earth Minerals মজুদে শীর্ষে চীন: ভারত ও আমেরিকার ভূরাজনীতি

বিরল খনিজ বা Rare Earth Minerals হলো একগুচ্ছ মূল্যবান রাসায়নিক মৌল, যেগুলির ব্যবহার ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তির অগ্রগতি প্রায় অসম্ভব। স্মার্টফোন, ইলেকট্রিক যান, মিসাইল সিস্টেম, রাডার, সৌর প্যানেল ও উইন্ড টারবাইন তৈরিতে এই খনিজগুলো অত্যাবশ্যক। কিন্তু সমস্যা হলো — এই খনিজের সঞ্চয় এবং উত্তোলন বিশ্বে খুব সীমিত কিছু অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত, যার মধ্যে চীন এককভাবে প্রায় ৬০-৭০% বিশ্ব বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।

বিরল খনিজ কী এবং কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

বিরল খনিজ বলতে সাধারণত ১৭টি রাসায়নিক মৌলকে বোঝানো হয় – যেমন নিওডিমিয়াম, প্রাসিওডিমিয়াম, লান্থানাম, সেরিয়াম ইত্যাদি। Read More⏩

এই উপাদানগুলির প্রয়োজনীয়তা প্রধানতঃ:

গ্রিন টেকনোলজি (EV, ব্যাটারি, উইন্ড টারবাইন)

ডিফেন্স ও অ্যারোস্পেস (জেট ইঞ্জিন, রাডার, গাইডেড মিসাইল)

ইলেকট্রনিক্স (স্মার্টফোন, কম্পিউটার চিপ, ফাইবার অপটিক্স)

বিরল খনিজ কি? Rare Earth Minerals মজুদে শীর্ষে চীন: ভারত ও আমেরিকার ভূরাজনীতি

এখন প্রশ্ন হচ্ছে — এগুলো পাওয়া এবং রিফাইন করা এত কঠিন কেন?

👉 কারণ এগুলোর খনিজ ঘনত্ব খুব কম এবং তুলনামূলকভাবে পরিবেশ দূষণকারী ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সেগুলো নিষ্কাশন করতে হয়।

চীনের একাধিপত্য:

চীন ১৯৮০-র দশক থেকেই পরিকল্পিতভাবে বিরল খনিজ খাতকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। বর্তমানে চীন:

বিশ্বের প্রায় ৮০%-এর বেশি রেয়ার আর্থ রিফাইনিং প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।

➤যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন— এদের বড় অংশ চীন থেকেই রেয়ার আর্থ আমদানি করে।

চীন তার খনিজ নীতিকে ব্যবহার করছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের অস্ত্র হিসেবে। যেমন ২০১০ সালে জাপানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে চীন রেয়ার আর্থ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। Read More⏩

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ও প্রতিরোধ কৌশল

যুক্তরাষ্ট্র, এক সময় রেয়ার আর্থ উৎপাদনে শীর্ষে থাকলেও, পরিবেশগত উদ্বেগ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ার কারণে তাদের খনিজ খাত প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। তবে চীনের আধিপত্য ঠেকাতে তারা এখন নিচের পদক্ষেপগুলো নিয়েছে:

MOUNTAIN PASS Mine (ক্যালিফোর্নিয়া): পুনরায় সক্রিয় করা হয়েছে।

➤QUAD & NATO সহযোগিতা: অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারতসহ মিত্র রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে খনিজ শৃঙ্খল গড়ে তোলা।

➤অর্থনৈতিক প্রণোদনা: রেয়ার আর্থ খাতকে চাঙা করতে বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ।

ভারতের ভূমিকা ও সম্ভাবনা

ভারতে রেয়ার আর্থ খনিজের বড় সম্ভাবনা রয়েছে, বিশেষত:

মনাজাইট বালু (Monazite Sands) সমৃদ্ধ তামিলনাড়ু, ওড়িশা ও কেরালা উপকূল

আইআরইএল (Indian Rare Earths Limited) এর মাধ্যমে সরকার খনিজ নিষ্কাশনে উদ্যোগী।

➤২০২৩ সালে ভারত-অস্ট্রেলিয়া একসাথে Critical Minerals Partnership করেছে।

➤ISRO ও DRDO-র মতো প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ সংস্থাগুলির জন্য এই খনিজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তবে ভারতের সমস্যা হলো:

➤নীতিগত জটিলতা

➤পরিবেশগত বাধা

➤খনিজ প্রক্রিয়াজাতকরণে সীমিত দক্ষতা

অন্যান্য দেশের অবস্থান

অস্ট্রেলিয়া: বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরল খনিজ উৎপাদক (Lynas Corp)।

জাপান: চীনের বিকল্প সরবরাহ উৎস হিসেবে ভারত, ভিয়েতনাম ও আফ্রিকায় বিনিয়োগ করছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন: নিজস্ব রেয়ার আর্থ কৌশল প্রণয়ন করেছে ২০২২ সালে।

আফ্রিকা: চীন আফ্রিকার অনেক খনিজ খাতে আগেই বিনিয়োগ করেছে, ফলে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো এখানেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করেছে। Read More⏩

ভূরাজনৈতিক সংঘর্ষ ও ভবিষ্যৎ যুদ্ধ

রেয়ার আর্থ খনিজ এখন আর কেবল প্রযুক্তির উপাদান নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে এক ভূরাজনৈতিক অস্ত্র।

চীন বনাম যুক্তরাষ্ট্র: প্রযুক্তিগত এবং বাণিজ্যিক আধিপত্যের লড়াইয়ে রেয়ার আর্থ কৌশল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র।

টেক ডিকাপলিং: পশ্চিমা দেশগুলো চীনা সরবরাহ শৃঙ্খল থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

নতুন কোল্ড ওয়ার: প্রযুক্তি, মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা খাতে নতুন ধরনের কৌশলগত যুদ্ধ শুরু হয়েছে


বিশ্ব আজ এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে বিরল খনিজ ভবিষ্যতের জ্বালানি ও শক্তি। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ইঞ্জিন এই খনিজগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত সহ বিশ্বশক্তিগুলো একটি "নিঃশব্দ যুদ্ধ" লড়ছে। ভবিষ্যতের যুদ্ধ শুধু অস্ত্র বা সেনাবাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না—বরং খনিজ সম্পদ, চিপস এবং তথ্য হবে এই যুদ্ধের প্রধান মারণাস্ত্র।